ঢাকা, ১৪ এপ্রিল : আজ পহেলা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। চৈত্র সংক্রান্তির মাধ্যমে গতকাল বিদায় নিয়েছে ১৪৩১ সন। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আজ যুক্ত হলো নতুন বছর। স্বাগত ১৪৩২। আজ জীর্ণ-পুরাতনকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করবে বাঙ্গালি জাতি। সকালে ভোরের প্রথম আলো রাঙ্গিয়ে দেবে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। বিশ্ব জুড়ে থাকবে বাংলা ভাষা-ভাষীদের প্রাণের উৎসব বর্ষবরণের নানা আয়োজন।
কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসন ভিত্তি করে প্রবর্তন হয় নতুন এই বাংলা সন। ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এ সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসের সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরী হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ৬০ এর দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাঙ্গালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ১৮৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনষ্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয় । বর্তমানে বাংলা নববর্ষ পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসবে, বাঙ্গালির প্রাণের উৎসবে। এ উৎসব বাঙ্গালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজ বর্ষবরণের এ উৎসব আমেজে মুখরিত থাকবে বাংলার চারদিক। গ্রীষ্মের খরতাপ উপেক্ষা করে বাঙ্গালি মিলিত হবে তার সর্বজনীন এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবে। দেশের পথে-ঘাটে, মাঠে-মেলায় অনুষ্ঠানে থাকবে কোটি মানুষের প্রাণের চাঞ্চল্য। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে সবশ্রেণীর নাগরিক এ উৎসবে অংশ নেবে। বাঙ্গালি সংস্কৃতির উপর আঘাত, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা জঙ্গিবাদ এর মতো অপশক্তির অন্ধকার কাটিয়ে নতুন আলোয় আলোকিত করার প্রত্যয়ে শহর, গ্রামজুড়ে বসবে উৎসবের মেলা। সবাই একসুরে গেয়ে উঠবে এসো হে বৈশাখ, এসো এসো....।
হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজ বাঙ্গালি হারিয়ে যাবে বাধভাঙ্গা উল্লাসে। উৎসব, আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভরে যাবে বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। আজকের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো সব জরা গ্লানিকে মুছে ফেলে সকলে গেয়ে ওঠবে নতুন দিনের গান। বৈশাখী উৎসবের মধ্য দিয়ে যেন বাঙ্গালি তার শেকড় খুজে পায়। বছরের প্রথম দিনে আজ নতুন নতুন স্বপ্ন বুনবে বাংলার কৃষক। হালখাতা খুলবে ব্যবসায়ীরা। সারাদেশে একযোগে চলবে লোকজ ঐতিহ্যের নানা উৎসব অনুষ্ঠান। বসবে মেলা। শিশুরা তালপাতার সেপাই, টমটম গাড়ি, ঢোলক আর বাশি নিয়ে বাড়ি ফিরবে। ঐতিহ্যবাহী খাবারের আয়োজন থাকবে ঘরে ঘরে, বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে। সাদা আর লাল কম্বিনেশনের পাঞ্জাবি ফতুয়া পড়ে শিশু তরুণ যুবা ও মাঝ বয়সীরা ঘুরে বেড়াবে। কিশোরী তরুণী ও নারীকুল খোপায় ফুল পরে রকমারি সাজে সজ্জিত হয়ে শামিল হবে বর্ষবরণের অনাবিল আনন্দযজ্ঞে।
আজ পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মাতবে দেশ। রাজধানী এবং সারাদেশ জুড়ে থাকবে বর্ষবরণের নানা আয়োজন। ‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩২’ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে উদ্যাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। দিনটি সরকারি ছুটির দিন। বাংলা নববর্ষের ইতিহাস ও ইউনেস্কো কর্তৃক এটিকে বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে এদিন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ সকাল ৯টায় শুরু হবে। এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য “নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান”। শোভাযাত্রা শুধু এক সাংস্কৃতিক উৎসব নয়, বরং এক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের ভাষাও হয়ে উঠেছে। শোভাযাত্রায় সাতটি বড়, সাতটি মাঝারি এবং সাতটি ছোট মোটিফ বহন করা হবে, এতে থাকবে বাঙালির ঐতিহ্য, জীববৈচিত্র্য ও সমাজের নানা অসাম্যের প্রতীকী প্রতিবাদের চিত্র। ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, এমনকি বিদেশি অতিথিরাও অংশ নিবেন এই আয়োজনে। শোভাযাত্রাটি চারুকলা থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড়, টিএসসি, শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা হয়ে পুনরায় চারুকলায় গিয়ে শেষ হবে। এত বিশাল আয়োজনে ঢাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে নজিরবিহীন। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানিয়েছেন, পুরো শোভাযাত্রা ও আশপাশের এলাকাকে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে। মোট ২১টি সেক্টরে ভাগ করে শহরে মোতায়েন করা হয়েছে ১৮ হাজার পুলিশ সদস্য, র্যাব, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থা। প্রতিটি প্রবেশপথে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি, সিসি ক্যামেরা, ড্রোন ও স্ট্যাটিক ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখা হবে। রয়েছে ডগ স্কোয়াডের সুইপিং, লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড কেন্দ্র, ও বিশেষ সাইবার নজরদারিও। নগরবাসীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে ব্যাগ, ধারালো বস্তু বা দাহ্য পদার্থ সঙ্গে না আনতে এবং শোভাযাত্রায় নির্ধারিত পথ ছাড়া প্রবেশ না করতে। রমনার বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানও আজ অনুষ্ঠিত হবে ভোরে। রবীন্দ্রসংগীত, লোকসঙ্গীত ও আবৃত্তিতে ভোরবেলায় গেয়ে উঠবে “এসো হে বৈশাখ, এসো এসো” এই সুরেই জেগে উঠবে বাঙালির প্রাণ। নগরবাসী সপরিবারে ভিড় জমাবে প্রিয় এই আয়োজন উপভোগ করতে। নারী ও শিশুর জন্য আলাদা প্রবেশ ও প্রস্থানের ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ও সহায়তাকারী স্বেচ্ছাসেবক দলও কাজ করবে সেখানে। বর্ষবরণ উপলক্ষে আতশবাজি, ফানুস ও উচ্চ শব্দের বাঁশি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দুপুর ২টার মধ্যে সব অনুষ্ঠান শেষ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে আয়োজকদের। বিকেল ৫টার পর সকল স্থানে প্রবেশ সীমিত করা হয়েছে। পহেলা বৈশাখ বাঙালির চিরায়ত পরিচয় বহন করে। ধর্ম-বর্ণ, জাতি বা শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই এই উৎসবে মেতে ওঠে। এটি কেবল একটি দিন নয়, বরং বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ। নানা প্রতিকূলতা, রাজনৈতিক জটিলতা, নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ সবকিছুকে ছাপিয়ে আজ রাজধানীসহ সারাদেশেই উচ্চারিত হচ্ছে একটাই সুর: নতুন বছর হোক আলোর, শান্তির ও সম্ভাবনার।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan